বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - NCTB BOOK

পৃথিবী নামের এ গ্রহটিতে অনেকগুলো দেশ আছে। দেশগুলো বিশ্বের সাতটি মহাদেশে বিভক্ত । স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলেও দেশগুলোর পক্ষে একা চলা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব যা বিশ্ব শান্তি ও এসব দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য । বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতার প্রয়োজন থেকে বিশ্বে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সহযোগিতামূলক সংগঠন । যেমন : সার্ক, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘ ইত্যাদি । এ অধ্যায়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন এবং বাংলাদেশের সাথে এদের সম্পর্ক বিষয়ে আমরা জানব ।

এ অধ্যায় পড়া শেষে আমরা-

♦ জাতিসংঘের গঠন ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে পারব

♦জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্ণনা করতে পারব

♦ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারব

♦ কমনওয়েলথের গঠন, উদ্দেশ্য এবং বাংলাদেশের সাথে এর সম্পর্ক বর্ণনা করতে পারব

♦ ওআইসির গঠন, উদ্দেশ্য এবং বাংলাদেশের সাথে এর সম্পর্ক বর্ণনা করতে পারব

♦ সার্কের গঠন, উদ্দেশ্য এবং বাংলাদেশের সাথে এর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে পারব ।

Content added By

মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে পৃথিবীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে । প্রথমটি ছিল ১৯১৪-১৯১৮ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়টি ১৯৩৯-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত । বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এসব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল । বিশ্বযুদ্ধ দুটি ছিল মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় বিরাট বাধা। সেজন্য যুদ্ধের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী চলেছে শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা । তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯২০ সালে গঠিত হয়েছিল জাতিপুঞ্জ বা লিগ অব নেশনস । কিন্তু বিভিন্ন দেশের স্বার্থের সংঘাতের কারণে এ সংস্থাটি স্থায়িত্ব লাভ করেনি। ফলে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে গ্রাস করে । এ যুদ্ধে বিভিন্ন দেশের ব্যাপক ক্ষতি হয় । আণবিক বোমার আঘাতে জাপানের দুটি শহর (হিরোশিমা ও নাগাসাকি) সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা দেখে বিশ্ববাসী শংকিত ও হতবাক হয়ে যায়। তাদের মনে বিভিন্ন দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধে। এছাড়া তারা অনুভব করে, মানবকল্যাণের জন্য যুদ্ধকে পরিহার করতে হবে। দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে হবে । ফলে ১৯৪১ সাল থেকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হাতে নেয়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৫ সালের ২৪শে অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে । এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় জাতিসংঘের জন্ম ।

শুরুতে জাতিসংঘের সদস্যসংখ্যা ছিল ৫১। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৯৩। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এর সদর দপ্তর অবস্থিত। জাতিসংঘের মহাসচিব হচ্ছেন এর প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। নরওয়ের অধিবাসী ট্রিগভেলি ছিলেন জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব। বর্তমান মহাসচিবের নাম আস্তনিও গুতেরেস (Antonio Guterres)। তিনি পর্তুগালের অধিবাসী। গুতেরেস ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। জাতিসংঘের পতাকাটি হালকা নীল রঙের। মাঝখানে সাদা জমিনের মধ্যে বিশ্বের বৃত্তাকার মানচিত্র রয়েছে। এর দুপাশ দুটি জলপাই পাতার ঝাড় দিয়ে বেষ্টিত। জাতিসংঘের রয়েছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সংস্থা। এর মধ্যে ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, বিশ্ব মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

Content added By

জাতিসংঘের উদ্দেশ্য

বিশ্বশান্তি ও সহযোগিতার মহান লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের উদ্দেশ্যগুলো হলো-

১. শান্তির প্রতি হুমকি ও আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করে বিশ্ব শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; ও

২. সকল মানুষের সমান অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের মধ্যে সম্প্রীতি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা;

৩. অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবসেবামূলক সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে ভোলা:

৪. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা; এ

৫. আন্তর্জাতিক আইনের সাহায্যে আন্তর্জাতিক বিবাদের মীমাংসা করা।

 

Content added By

১. সাধারণ পরিষদ:

গঠন: সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের আইনসভার মতো । জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র সাধারণ পরিষদের সদস্য । সাধারণত বছরে একবার এ পরিষদের অধিবেশন বসে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের অনুরোধে বিশেষ অধিবেশন বসতে পারে। প্রত্যেক অধিবেশনের শুরুতে সদস্যদের ভোটে পরিষদের একজন সভাপতি নির্বাচিত হন । সাধারণ পরিষদে প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের একটিমাত্র ভোট দানের অধিকার আছে ।

কার্যাবলি:
বিশ্বশান্তি ও সহযোগিতা রক্ষায় এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ পরিষদ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাসহ মানবাধিকারসংক্রান্ত বিষয় আলোচনা করে । এছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব নিয়োগ, নতুন সদস্য গ্রহণ, বাজেট পাস, সদস্য রাষ্ট্রের চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ, বিভিন্ন সংস্থার সদস্য নির্বাচন, নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ পরিষদ সম্পাদন করে থাকে ।

 

২. নিরাপত্তা পরিষদ:

গঠন: নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের শাসন বিভাগ স্বরূপ। নিরাপত্তা পরিষদ মোট ১৫টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত । এর মধ্যে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য । বাকি ১০টি অস্থায়ী সদস্য। স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র হলো- যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন। এরা বৃহৎ পঞ্চশক্তি নামে পরিচিত। অস্থায়ী সদস্যরা প্রতি দুবছরের জন্য নির্বাচিত হয় ।

কার্যাবলি:
জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী শাখা হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ । বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের। এ পরিষদ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করে। আগ্রাসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে পারে । এ চেষ্টা ব্যর্থ হলে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে । তাছাড়া নিরাপত্তা পরিষদ শান্তি প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধ বন্ধের জন্য কোথাও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে পারে। মোটকথা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল কাজ এ সংস্থাটি করে থাকে ।

 

৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ:
বিশ্বকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এ পরিষদ গঠিত হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ।

গঠন:
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ মোট ৫৪টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত। বছরে কমপক্ষে তিনবার এর অধিবেশন হয় । প্রত্যেক সদস্যের একটি করে ভোট দানের অধিকার আছে । সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে যেকোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।

কার্যাবলি:
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বেকার সমস্যার সমাধান খাদ্য, কৃষি ও শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, মৌলিক মানবাধিকার কার্যকর করা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কল্যাণমূলক কাজ করে । এছাড়া বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক বিষয়ে সাধারণ পরিষদে সুপারিশ প্রেরণ করা এ পরিষদের অন্যতম দায়িত্ব ।

 

৪. অছি পরিষদ:
বিশ্বের যেসব জনপদের পৃথক সত্তা আছে কিন্তু স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নেই এবং অন্য রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় তাকে অছি এলাকা বলে । এসব এলাকার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব জাতিসংঘের অছি পরিষদের ।

গঠন:
অছি এলাকার উপর শাসন ক্ষমতার অধিকারী জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ও নির্বাচিত অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে অছি পরিষদ গঠিত । এর কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নেই । অছি এলাকার সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এর সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ।

কার্যাবলি:
অছি পরিষদের মাধ্যমে জাতিসংঘ বিশ্বের অনুন্নত অঞ্চলের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয় । অছিভুক্ত অঞ্চলের উন্নতি এবং এলাকার অধিবাসীদের শিক্ষা প্রদান ও সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলাই হচ্ছে অছি পরিষদের দায়িত্ব । এছাড়া অছি এলাকায় শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অছি এলাকার জনগণের আবেদন ও অভিযোগ পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া এবং অছি এলাকা পরিদর্শনের মাধ্যমে বাস্তব অবস্থা দেখা ও প্রতিবেদন পেশ করা অছি পরিষদের কাজ ।

 

৫. আন্তর্জাতিক আদালত:
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিবাদ মীমাংসার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করা হয়েছে । এর সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডের দি হেগ শহরে অবস্থিত ।

গঠন:
আন্তর্জাতিক আদালত জাতিসংঘের বিচারালয়। পনেরজন (১৫) বিচারক নিয়ে এ আদালত গঠিত। বিচারকদের কার্যকাল নয় বছর। সাধারণ ও নিরাপত্তা পরিষদ মিলে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকদের নিয়োগ করে।

কার্যাবলি:
জাতিসংঘের যেকোনো সদস্য রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বিরোধ মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার প্রার্থনা করতে পারে। আদালত তার বিচারকার্য দ্বারা বিশ্বশান্তি রক্ষা করে। জাতিসংঘ সনদের অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয় নিয়ে মামলা হলে এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পাদিত কোনো চুক্তি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলেও আন্তর্জাতিক আদালত তা মীমাংসা করে । এছাড়া সাধারণ ও নিরাপত্তা পরিষদ কোনো আইনের ব্যাখ্যা চাইলে আন্তর্জাতিক আদালত তার ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে ।

 

৬. জাতিসংঘ সচিবালয়:
সচিবালয় জাতিসংঘের প্রশাসনিক বিভাগ। বিশ্বশান্তি, সহযোগিতা ও যোগাযোগ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ এ শাখার মাধ্যমে সম্পাদিত হয় ।

গঠন:
জাতিসংঘ মহাসচিব, কয়েকজন উপমহাসচিব, অধস্তন মহাসচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে এ বিভাগ গঠিত । এর প্রধান কর্মকর্তা হলেন মহাসচিব । সাধারণ পরিষদ কর্তৃক তিনি পাঁচ বছরের জন্য
নির্বাচিত হন ।

কার্যাবলি:
জাতিসংঘ সচিবালয় জাতিসংঘের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করে। সচিবালয়ের মহাসচিবকে কেন্দ্র করে এর যাবতীয় কাজ আবর্তিত হয়ে থাকে । তিনি সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ এবং অছি পরিষদের মহাসচিব হিসেবে কাজ করেন। আন্তর্জাতিক আদালত ছাড়া সকল শাখায় লোক নিয়োগের দায়িত্বও তাঁর । সকল শাখার অধিবেশন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তাঁর । এছাড়া জাতিসংঘের বাজেট তৈরি, সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন শাখার সভা আহ্বান, বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা ও প্রতিবেদন তৈরি, অছি এলাকার রিপোর্ট তৈরি ইত্যাদি কাজ তাঁর নির্দেশনায় সম্পাদিত হয়ে থাকে । সাধারণ ও নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার দায়িত্ব তাঁর। জাতিসংঘের নির্দেশ অমান্যকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারেন। মহাসচিব জাতিসংঘের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সচিবালয়ের অন্যান্যদের সহযোগিতায় তিনি এ ব্যাপক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকেন ।

Content added By

জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক

বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে । জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের নীতি ও আদর্শের প্রতি আস্থাশীল রয়েছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে তার নানা সমস্যা মোকাবেলায় জাতিসংঘের সহযোগিতা পেয়েছে । আবার জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে । কার্যত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের গভীর ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নিচে এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো ।

♦ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীকে জাতিসংঘ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি মানবিক সাহায্য দিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল । স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনেও জাতিসংঘ সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল ।

♦ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয় । ফলে বাংলাদেশ অতি অল্প দিনের মধ্যে জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্যের আস্থাভাজন হয়ে উঠে । বাংলাদেশ এ পর্যন্ত দুবার নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে যা দেশের জন্য এক বিরল সম্মান । এছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘের অন্যান্য পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে ।

♦ জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অকৃত্রিম বন্ধুর মতো কাজ করে যাচ্ছে। এসব সংস্থা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি, যোগাযোগ, শিশু মৃত্যু হ্রাস, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, বিজ্ঞান, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অগ্রগতি অর্জনে যথেষ্ট সাহায্য করছে। জাতিসংঘ আমাদের ‘ভাষা ও শহীদ দিবস' ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছে । জাতিসংঘের এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সাথে জাতিসংঘের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করেছে ।

♦ ১৯৯১ সালে মিয়ানমার হতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করায় এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশকে বিপুলভাবে সাহায্য করায় বাংলাদেশ সে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ ছিল যা নিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে । ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের এক রায়ে এ বিরোধের নিষ্পত্তি হয় এবং এক বিশাল সমুদ্রসীমার উপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ।

♦ এভাবে জাতিসংঘ বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আমাদের দেশকে সাহায্য করে যাচ্ছে। বাংলাদেশও জাতিসংঘ সনদের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাশীল থেকে এর বিভিন্ন অধিবেশনে যোগদান করে এবং গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে বিশ্ব শাস্তি রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে ।

Content added || updated By

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা

জাতিসংঘের নিজস্ব কোন বাহিনী নেই। সদস্য দেশগুলো থেকে প্রেরিত সামরিক সদস্যরাই এর প্রধান শক্তি। নিরাপত্তা পরিষদের তত্ত্বাধানে বিভিন্ন দেশের সামরিক, বেসামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী নিয়ে এই শান্তি রক্ষা বাহিনী গঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর অন্যতম সদস্য দেশ। শুরু থেকেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর কর্মকাণ্ডে সমর্থন ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। সর্বপ্রথম ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ নামিবিয়া (UNITAG) এবং ইরাক-ইরানে (UNIIMOG) দুটি শান্তিরক্ষার অপারেশনে অংশগ্রহণের জন্য সেনাসদস্য প্রেরন করে। তখন থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ৪০টি দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষাকারী মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে সেনাসদস্য প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষস্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে এ পর্যন্ত প্রায় ১.৪৬ লক্ষ সেনাসদস্য পাঠিয়েছে। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭১০ জন নারী পুলিশ সদস্য মিশন শেষ করে দেশে ফিরেছেন।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান খুবই গৌরবের। এ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কমান্ডার হিসেবেও ঊর্ধ্বতন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । এটি বাংলাদেশের ভূমিকার আরেকটি স্বীকৃতি, যা দেশের মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি করেছে । বাংলাদেশের এ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিবিসি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষাকারীদের The cream of UN peacekeepers' বলে আখ্যায়িত করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের এ অবদান আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় ।

Content added || updated By

গঠন:

আমরা জানি, একসময় ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল। ব্রিটিশরা সে সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে । কিন্তু পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি হয় এবং কোনো কোনো দেশে ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটতে শুরু করে এবং একের পর এক দেশ স্বাধীন হতে থাকে। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ব্রিটেন শাসন থেকে মুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন ধরে রাখার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে কমনওয়েলথ। ব্রিটেন এটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ব্রিটেন ও এর পূর্বতন অধীনস্ত দেশসমূহ এর সদস্য। তবে কোনো রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে কমনওয়েলথের সদস্য নাও হতে পারে। এর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫৪।
কমনওয়েলথ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ১৯৪৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে এর নাম ছিল 'ব্রিটিশ কমনওয়েলথ অব নেশনস' । পরবর্তীকালে 'ব্রিটিশ' কথাটি বাদ দেওয়া হয় । ব্রিটেনের রাজা বা রানী কমনওয়েলথের প্রধান। এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিজস্ব সচিবালয় আছে। সচিবালয়ের প্রধানকে বলা হয় ‘মহাসচিব’। এর সদর দপ্তর লন্ডনে অবস্থিত । প্রতি দুই বছর পর পর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
ব্রিটেনের রানী ও কমনওয়েলথ প্রধান কমনওয়েলথের প্রধান লক্ষ্য হলো ব্রিটেন ও এর স্বাধীন উপনিবেশগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সম্পর্ক রক্ষা । এই সম্পর্ক ধরে রাখার মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং দেশগুলোর পরস্পরের মধ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আদান-প্রদানে সহায়তা করার মাধ্যমে দেশগুলোর অগ্রগতি সাধন করাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য ।

বাংলাদেশ ও কমনওয়েলথ:
স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২ সালের ১৮ই এপ্রিল বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভ করে । বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই কমনওয়েলথের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। বিশেষ করে, কমনওয়েলথের মূল উদ্যোক্তা যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রচারমাধ্যমগুলো বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেছিল । ব্রিটেন ছিল বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারকার্য পরিচালনা করার প্রধান কেন্দ্ৰ ৷ সেখানে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশের জন্য সাহায্য তহবিল । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশও বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। কমনওয়েলথভুক্ত আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোককে আশ্রয় ও খাদ্য দিয়েছে । অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র ঔষধ, খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে ।

বাংলাদেশের প্রতি উদার মনোভাব ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদ পায় । এর প্রতিবাদে পাকিস্তান কমনওয়েলথ থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেয় । কমনওয়েলথ ও এর সদস্য দেশগুলোর সহায়তায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশ কমনওয়েলথের একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে এর প্রতিটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। কমনওয়েলথের নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে । কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ কলম্বো পরিকল্পনার সদস্য। এর ফলে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় ।

কমনওয়েলথ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আন্তর্জাতিক একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এটি বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি রক্ষায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিশ্ব থেকে বর্ণবৈষম্য ও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করছে ।

Content added || updated By

ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)

গঠন:
বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলোর একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হচ্ছে ওআইসি। এর পুরো নাম Organization of Islamic Co-operation (OIC)। বাংলায় একে বলা হয় “ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা' । আমরা জানি, দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে ইসরাইল ও এর পশ্চিমা বিশ্বের মিত্রদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর বিরোধ চলে আসছে। এ বিরোধের একপর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ২১শে আগস্ট ইসরাইল অতর্কিতে মুসলমানদের পবিত্র মসজিদ আল আকসায় অগ্নিসংযোগ করে । 

সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এর তীব্র নিন্দা জানায় ও ক্ষোভ প্রকাশ করে । এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিসরে ১৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । ঐ সম্মেলনে মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধানদের নিয়ে একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । সে অনুযায়ী ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২২ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ২৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে মরোক্কোর রাজধানী রাবাতে এক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থরক্ষায় একটি সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ওআইসি গঠিত হয় । মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেংকু আব্দুর রহমানকে ওআইসির প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল বা মহাসচিব নিযুক্ত করা হয় । এভাবেই শুরু হয় ওআইসির যাত্রা। শুরুতে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ২৩ । বর্তমান ওআইসির সদস্যসংখ্যা ৫৭। বিশ্বের সব মুসলিম রাষ্ট্রই এর সদস্য। ওআইসির সদর দপ্তর সৌদি আরবের জেদ্দায় ।
 

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রেখে শত্রুর কবল থেকে ইসলামি স্থানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা ওআইসির প্রাথমিক লক্ষ্য । এছাড়া ওআইসির আরও কিছু উদ্দেশ্য আছে ।

১. ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি জোরদার করা;

২. সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা; ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সদস্য

৩. বর্ণবৈষম্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিলোপ করা;

8. ইসলামি পবিত্র স্থানগুলোর নিরাপত্তা বিধান করা, পবিত্র ভূমিকে মুক্ত করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামকে সমর্থন করা;

৫. মুসলমানদের মর্যাদা রক্ষা এবং মুসলিম জাতির সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য সাহায্য করা;

৬. আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সমর্থন করা;

৭. সংস্থাভুক্ত সকল দেশ ও অন্যান্য দেশের সাথে সৌহার্দ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা;

৮. দেশসমূহের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো; এবং

৯. কোনো সংঘর্ষ দেখা দিলে আলাপ-আলোচনা, মধ্যস্থতা, আপোস প্রভৃতির মাধ্যমে এর শান্তিপূর্ণ সমাধান ।

 

বাংলাদেশ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা:
বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে ওআইসির সদস্যপদ পায় । এই সদস্যপদ লাভের মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে । শুরু থেকে বাংলাদেশ ওআইসির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছে। ওআইসিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বাংলাদেশকে এর প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, অঙ্গসংগঠন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কমিটির সদস্য করা হয়েছে। ওআইসির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি সংহতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে যথাসম্ভব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন-ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অব্যাহত সমর্থন জানিয়ে আসছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রাসনকে নিন্দা জানিয়েছে । বসনিয়ায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য সৈন্য পাঠিয়েছে ।

বাংলাদেশ ওআইসিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এর সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা লাভেও সমর্থ হয়েছে । ওআইসির সদস্যপদ বাংলাদেশকে বিভিন্ন মুসলিম দেশের স্বীকৃতি অর্জন এবং জাতিসংঘের সদস্যপদসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ লাভে সাহায্য করেছে । যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোর সহযোগিতা পেয়েছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোতে বাংলাদেশের বিশাল জনশক্তি রপ্তানি যা কর্মসংস্থানসহ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়াও শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য দেশগুলোর সহযোগিতা লাভ করে আসছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের বহুসংখ্যক লোক পবিত্র হজ্জব্রত পালনের জন্য সৌদি আরব যায় । তাছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং পুরাতন মসজিদ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ওআইসির কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পায় । গাজীপুরে অবস্থিত ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি' ওআইসির আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হচ্ছে ।
বস্তুত বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হওয়ার পর থেকে এর নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

Content added By

সার্কের পুরো নাম দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (South Asian Association for Regional Cooperation)। শুরুতে এটি দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত হয় । পরবর্তীকালে ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কের ৮ম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সার্ক একটি আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা । 

গঠন:
১৯৮৫ সালের ৮ই ডিসেম্বরে ঢাকায় সার্কের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয় । বর্তমানে এর সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা আটটি। রাষ্ট্রগুলো হলো- বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান।
সার্কের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে পাঁচটি স্তর আছে। এগুলো হলো- ১) রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন ২) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন, ৩) স্ট্যান্ডিং কমিটি, ৪) টেকনিক্যাল কমিটি এবং ৫) সার্ক সচিবালয় । এগুলোর মাধ্যমে সার্কের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পাদন করা হয়ে থাকে ।
সার্ক সচিবালয় নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অবস্থিত। এর প্রধানকে বলা হয় সেক্রেটারি জেনারেল । প্রতিবছর সার্কভুক্ত দেশগুলোর প্রধানদের নিয়ে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রায় ১৭৫ কোটি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ।

সার্ক গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, অপুষ্টি, জনসংখ্যার আধিক্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি এসব দেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এসব সমস্যা দুরীকরণ ও পারস্পরিক উন্নয়নের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে সার্ক গঠিত হয়। এছাড়াও সার্ক গঠনের আরও কতগুলো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। এগুলো আলোচনা করা হলো।

১। সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা;

২। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং সংস্কৃতির বিকাশ নিশ্চিত করা;

৩। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে জাতীয়ভাবে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ
করা;

৪। এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সাধারণ স্বার্থে সহানুভূতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা;

৫। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন;

৬। অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে সার্কের লক্ষ্য বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া;

৭। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিরাজমান বিরোধ ও সমস্যা দূর করে পারস্পরিক সমঝোতা সৃষ্টি করা;

৮ । দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার নীতি মেনে চলা এবং

৯ । অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা ।

সার্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক:
সার্কের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। আশির দশকে সার্ক গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও মূলত: ১৯৮৫ সালে ঢাকা সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্ক যাত্রা শুরু করে। সার্কের উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশ সার্কের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সার্কের সদস্য হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ভারসাম্য রক্ষা, আঞ্চলিক বিরোধ নিষ্পত্তি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সংকট সমাধানে বাংলাদেশ অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।

এছাড়া সদস্য দেশগুলোতে মানবপাচার রোধ, সন্ত্রাস দমন, পরিবেশ সংরক্ষণ, যোগাযোগ ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, রোগ-ব্যাধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ । এসব ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য নানা ধরনের যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে । এগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সার্কের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

Content added By
Promotion